জামে তিরমিযী
লেখক : ইমাম হাফেজ আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযী
বই সম্পর্কে
জামে তিরমিযী গ্রন্থটি গোটাবিশ্বে বিশুদ্ধতার বিবেচনায় পরিচিত শীর্ষ ছয়টি হাদীস গ্রন্থের অন্যতম একটি। হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে তাহের মাকদেসী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হারাত নামক স্থানে ইমাম আবূ ইসমাঈল আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আনসারী (র.) কে আমি বলতে শুনেছি, যখন তার সামনে জামে তিরমিযী সম্পর্কে আলোচনা উঠলো তখন তিনি বললেন, আমার নিকট পাঠকের জন্য সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের তুলনায় জামে তিরমিযী অধিক উপকারী। কেননা, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম থেকে কেবলমাত্র বড় বড় আলেমগণ উপকৃত হতে পারেন। কিন্তু ইমাম তিরমিযীর কিতাব থেকে সকলেই খুব সহজে উপকৃত হতে পারেন।
জামেউল উসূল নামক গ্রন্থে আল্লামা ইবনে আল আতির (র.) বলেছেন, হাদীসের এ গ্রন্থটি সর্বাধিক উপকারী একটি গ্রন্থ, এতে হাদীসের পুনরাবৃত্তিসহ এমন অনেক হাদীস রয়েছে যা অন্য গ্রন্থগুলোতে নেই। যেমন বিভিন্ন মাযহাবের ইমামদের অভিমত, দলিল ও যুক্তিভিত্তিক প্রমাণাদী উল্লেখ, হাদীসের মানদ- তথা সহীহ, হাসান, গরিব ও যঈফ তথা দুর্বল হওয়ার কারণ নির্ণয়। পাশাপাশি রাবী তথা বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান। তাছাড়া জামে তিরমিযীতে রয়েছে অত্যন্ত উপকারী ইলম ও হাদীসের মানদ- নির্ণয়ের জন্য সংক্ষিপ্তাকারে উসূলে হাদীস সংক্রান্ত আলোচনা, যা থেকে একজন শিক্ষার্থী সহজেই উপকৃত হতে পারে । সুনানে আবী দাঊদের পরে ইমাম আবূ ঈসা (র.) কর্তৃক সংকলিত যা সুনানে তিরমিযী নামে সুপরিচিত, চার সুনানের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে কতিপয় মুহাদ্দিস সুনানে তিরমিযীকে ছয়টি গ্রন্থের মধ্যে সেরা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যা বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে ভিত্তিতে নয়, বরং বিন্যস্ততার ভিত্তিতে। কেননা এটিকে এমন সুসংহতভাবে সংকলন করা হয়েছে, যার ফলে শুধু আলেমগণ নয় বরং সাধারণ লোকজনও সহজেই উপকৃত হতে পারে। তাছাড়া ইমাম তিরমিযী (র.) ইলমে হাদীসের উপকারী এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যা সিহাহ সিত্তার অন্য ছয়টির মধ্যে সাধারণত পাওয়া যায় না।
উদাহরণস্বরুপ, একটি অধ্যায়ে হাদীস বর্ণনা করার পরে তিনি প্রায়শই ইমাম আবূ হানীফা, আহমদ, শাফেয়ী, মালেক এবং অন্যান্য ফকীহদের ফিকহের বিখ্যাত দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেছেন এবং কেন তারা এই হাদীসের আলোকে এই অভিমত পেশ করেছেন বা অন্য হাদীসের আলোকে ভিন্ন একটি অভিমত পেশ করেছেন সেই কারণও বর্ণনা করেছেন। তাই এই গ্রন্থটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহ রেফারেন্স হিসেবে পরিণত হয়েছে।
একইভাবে, যদি তিনি নিষিদ্ধকরণ বা কোনো কিছুর আদেশের বিষয়ে একটি অধ্যায় উল্লেখ করেছেন, তবে সেগুলোর নিষিদ্ধ হওয়ার বা অনুমোদিত হওয়ার যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর সংগ্রহে ইমাম আদ-দারিমী কর্তৃক সংকলিত বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের জরাহ ও তাদীল বিষয়ক বক্তব্য সম্বলিত এমন একটি গ্রন্থ রয়েছে, যাঁর থেকে তিনি প্রায়শই উল্লেখ করে বলেছিলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি তাছাড়া তিনি তার সার্বাধিক বিখ্যাত উস্তাদ ইমাম বুখারীর কথা প্রায়শই উল্লেখ করেছেন যে, আমি মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করেছি বা আমি মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈলকে বলতে শুনেছি…….
আর ইমাম তিরমিযী যদি কোনো রাবীর কারণে হাদীসের সনদ অস্পষ্ট হতে পারে বলে মনে করেছেন তাহলে সে রাবীর নাম এবং সেই সাথে সাহাবীর নাম উল্লেখ করার বিষয়ে বিশদ বিবরণ পেশ করেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসের যে ত্রুটি বর্ণনা করেছেন তা তিনি হাদীসের প্রতি উদ্ধত করেছেন এবং হাদীসের সঠিক সনদটি উল্লেখ করেছেন, যাতে সনদের সমস্যা সহজেয় অনুমেয় হয় এবং সঠিক সনদ সম্পর্কে সহজেই জানা যায়।
ইমাম তিরমিযী কর্তৃক সংকলিত সুনানটির অন্যান্য সুনানগুলো থেকে স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট হলো- তিনি একটি হাদীস সম্পর্কে সামগ্রিক সঠিকতা ও উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যথায় একটি হাদীস সম্পর্কে সংক্ষেপে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। আর এটি এমন একটি বিষয় যা অন্য সুনানগুলোতে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ অধ্যয়ে ইমাম তিরমিযী এ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বর্ণনাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলো কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। এ জাতীয় বিষয়গুলো ব্যাপারে অবগতি লাভ করার জন্য তাঁর আল ইলাল আল-কাবির এবং আল-ইলাল আস-সগীর গ্রন্থ-সহ তাঁর সংকলিত ইলমুর রিজাল, ইলমুর রিওয়ায়াহ এবং ইলমুর জারাহ ওয়া তাদীল নামক গ্রন্থগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল কাদী ইবনে আল আরাবী হাদীসের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং তিনি সুনানে তিরমিযীর বৈশিষ্টগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এ সকল গ্রন্থগুলোর মাঝে ইমাম আবূ ঈসা (র.) কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থটির মতো অন্য কোনো গ্রন্থ নেই। কেননা আবূ ঈসার গ্রন্থে
চৌদ্দটি বিষয় রয়েছে-
১. ফিকহ সম্পর্কিত আলোচনা
২. ইলমুল হাদীস তথা হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য তথা হাদীসের সনদে কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা। হাদীসটি সহীহ নাকি যঈফ ইত্যাদি
৩. রাবীদের নাম ও উপনাম সম্পর্কে আালোচনা
৪. রাবী গ্রহণযোগ্য নাকি অগ্রহণযোগ্য
৫. রাবীদের কে কে রাসূলের সাক্ষাত পেয়েছেন এবং কে কে পাননি
৬. সনদ সম্পর্কে আলোচনা ।
৭. কোন হাদীসটি শায তা উল্লেখ
৮. কোন হাদীসটি মাওকুফ তা নির্ণয়
৯. কোন হাদীসটি মুদরাজ তা উল্লেখ
১০. যে হাদীস অনুযায়ী আমল হয় না তা চিহিৃতকরণ
১১. হাদীসের ব্যাপারে ইমামদের ইখতেলাফ উল্লেখ
১২. হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
১৩. রাবীদের সংখ্যা ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
১৪. আবওয়াব আকারে পুরো কিতাবটি সাজানো।
- কম্পিউটার কম্পোজ, তিন কালার ও উন্নতমানের আকর্ষণীয় কাগজে মুদ্রিত।
- হরকতবিহীন, যা দরসে বসার উপযোগী।
- দুর্বোধ্য ও সংশয়পূর্ণ শব্দাবলিতে প্রয়োজনীয় হরকত প্রদান।
- বহুল প্রচলিত হিন্দুস্তানি নুসখার অনুসরণ।
- শব্দগত ও অর্থগত ভুল সংশোধন।
- যতিচিহ্ন ও আধুনিক আরবি বানানরীতির আলোকে বিশুদ্ধ ইমলার (লেখ্যরীতি) প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ।
- ধারাবাহিকভাবে হাদীস নম্বর, কিতাব (অধ্যায়)-নম্বর এবং পর্বভিত্তিক বাব (পরিচ্ছেদ)-নম্বর প্রদান।
- প্রতিটি হাদীসের ধারাবাহিক হাদীস-নম্বরগুলো রঙ্গিনকরণ।
- যোগ্যতাসম্পন্ন, দক্ষ ও অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসীনে কেরাম দ্বারা সম্পাদিত।
- কিতাব/অধ্যায়গুলোকে ক্যালিওগ্রাফি করে লেখা।
- কুরআনের আয়াতসমূহ হরকতযুক্তরূপে রঙ্গীনকরণ।
- হাশিয়ার নামগুলো ক্যালিওগ্রাফি করে লেখা।
- অনায়াসে খুঁজে বের করার জন্য হাশিয়াগুলো পৃথক পৃথক অনুচ্ছেদে ক্রমিক নং সহ উল্লেখ ।
- ضمير -এর مرجع সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রতিটি ضمير ও তার مرجع -এর নিচে একটি নম্বর প্রদান।
- হাশিয়ায় অবস্থিত ভুল-ত্রুটি মূল উৎসগ্রন্থের সাথে মিলিয়ে সংশোধন।
- হাশিয়ার শেষে যে সকল উৎসগ্রন্থের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, পুরো নাম উল্লেখ করে তা সুস্পষ্টকরণ।
- কিতাবের শুরুতে উৎকৃষ্টমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ (مقدمة) ভূমিকা সংযুক্তকরণ।
- কিতাবের শেষে হাদীস ও পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখপূর্বক (معجم غريب الحديث) কঠিন ও জটিল শব্দাবলির ব্যাখ্যা সংযোজন।
লেখক সম্পর্কে
আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা (র.) তিরমিয শহরের বুগ নামক গ্রামে সুলাইম গোত্রের একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম তিরমিযী (র.) ইবনে সাঈদ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম এবং ইমাম আবূ দাঊদ (র.) প্রমুখ মনীষীগণের জ্ঞানের সন্ধানে বিশ বছর বয়সে কূফা, বসরা ও হিজাযের এলাকা ভ্রমন করেছিলেন। তিনি হাদীসশাস্ত্রের অনন্যগ্রন্থ সুনানে তিরমিযী সংকলন করেছেন, যা জগৎবিখ্যাত হাদীসের গ্রন্থাবলি সিহাহ সিত্তাহ-এর অন্তভুর্ক্ত, এছাড়াও তিনি আরো অনেক গ্রন্থ সংকলন করেছেন। যেগুলোর মাঝে সর্বাধিক পরিচিত হলো শামায়েলে তিরমিযী গ্রন্থটি। তিনি তীক্ষè মেধার ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। আল্লামা সাঈদ ইদরীস (র.) বলেন, ইমাম তিরমিযীকে মেধা ও স্মৃতিশক্তির উপমা হিসেবে পেশ করা হতো। তিনি খুবই আল্লাহভীরু ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার ভয় এতো বেশি ছিল যে, তিনি কাদঁতে কাঁদতে শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। প্রসিদ্ধ মতানুসারে ইমাম তিরমিযী (র.) ১৩ রজব ২৮৯ হিজরিতে তিরমিয শহরে ইন্তেকাল করেন।
Reviews
There are no reviews yet.